দ্বিতীয় পর্ব- উইলিয়াম শেকসপীয়ার এর বাড়ী | হেনলে স্ট্রিট, স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভন, ওয়ারউইকশায়ার, ইংলান্ড।

বিশ্বসাহিত্যের যারা কান্ডারী, কখোনো যদি তাঁদের নামের কোনো তালিকা তৈরি করা হয়, তাতে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই যে নামটি সেই তালিকায় প্রথম লেখা হবে, সেটি উইলিয়াম শেকসপীয়ার। সাড়ে চারশো বছরেরও আগে জন্মগ্রহন করে, আজও তিনি বিশ্বসাহিত্যের আঙ্গিনায় একইরকম ভাবে প্রাসঙ্গিক , প্রভাবশালী এবং ভাস্বর। তাই তাঁর বাড়ী দেখতে যাব ঠিক হতেই মনটা উতলা হয়ে উঠল।    

লেক ডিস্ট্রিক্ট, ইয়র্ক হয়ে আমরা পৌঁছলাম ”স্ট্রাটফোর্ড আপ-অন অ্যাভন”, শেকসপীয়ার এর জন্মস্খান তথা বাড়ী দেখতে। এখন (২০১৪ জুলাই) এখানে শেকসপীয়ারের জন্মের ৪৫০ বর্ষ পূর্তি উৎসব পালন চলছে।  চার দিক সেজে উঠেছে দারুন ভাবে। স্টেসন থেকে মিনিট দশেক দুরত্বে হাঁটা পথের বাঁ দিকে অ্যাভন নদীর পাশ দিয়ে শেকসপীয়ারের বাড়ী যাবার রাস্তা। নদীর বুকে শত শত রাজ হাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাস্তার দু পাশে রঙ্গীন কাপড় দিয়ে সাজানো সারি সারি প্রচুর অস্থায়ী দোকান তৈরি হয়েছে এই উপলক্ষে। ফেস্টুন পোস্টারে ছয়লাপ চার দিক।

প্রথমেই রয়েছে নিউ প্লেস, শেকসপীয়ার নিজে থাকতেন এখানে। দ্বোতলা এই বর্তমান ভবনটি শেকসপীয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট নতুনভাবে রেনোভেট করেছেন। আর, এখন বিশেষভাবে আধুনিকতায় ভরে এটিকে সাজানো হয়েছে বিশেষ এই ৪৫০ তম বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে।এখন শেকসপীয়ার সংক্রান্ত নানান জিনিষ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। এই অত্যাধুনিক শেকসপীয়ারকে দেখে চমকিত হতেই হল। লাল চামড়ার মলাটে বাঁধানো তাঁর হাতে লেখা একাধিক ম্যানাসক্রিপ্ট খোলা অবস্থায় কাঁচের বাক্সের মধ্যে প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা রয়েছে। রাখা রয়েছে এক ভিসিটার বুক যার শুরু ১৮১২ সালে। খ্যাতনামা ইংরাজ কবি ”জন কীটস” ১৮১৭ সালে এই বইতে মন্তব্য  ও মতামত লিখে সই করেছিলেন। কয়েকটি ভিসিটার বুক লাল চামড়ায় বাঁধিয়ে খোলা অবস্খায় কাঁচের বাক্সে রাখা রয়েছে, যার একটিতে দেখা যাচ্ছে জন কীটসের সই ও লিখিত মন্তব্য। দেখা যাচ্ছে  সেই সময়ের ও পরবর্তীতে অনেকগুলি ভিসাটার বুক, বইএর মত করে বাঁধিয়ে রাখা রযেছে। পাশেই একটি ঘরে শেকসপীয়ারের লেখা বিভিন্ন সময়ে ছাপা বহু বই কাঁচের বাক্সের ভিতর খোলা অবস্থায় প্রদর্শনের জন্য রাখা রয়েছে। এদের বেশিরভাগের পাতা এতই ঝুরঝুরে যে হাত লাগানো সম্ভবই নয়। কিন্তু প্রতিটি পাতাই অক্ষত ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে, এবং হয়ত এই পর্য্যায়ের রক্ষণাবেক্ষণ এদেশেই করা সম্ভব। আর একটি ঘরে সাজানো রয়েছে শেকসপীয়ারের লেখা প্রচুর বই যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় ও নানান দেশে ছাপানো। সেখানে একটি বাংলা ভাষায় লেখা বই শেকসপীয়ার কিশোর সমগ্র ও স্থান পেয়েছে দেখে যুগপত চমকিত, বিস্মিত, আর্শ্চয্যান্বিত ও আনন্দিত হলাম।

এর পর আমাদের এগিয়ে যাওয়া শেকসপীয়ার এর জন্ম স্থানের দিকে। সুন্দর গাছপালায় ছাওয়া পথ, তার একপাশে পুরো দেওয়াল জুড়ে শেকসপীয়ার এর বিভিন্ন বই ও লেখা সংক্রান্ত নানান অগুনতি ছবির এক বর্ণময়, অত্যাধুনিক প্রদর্শনী। গেট দিয়ে ঢকে আমরা এগিয়ে গেলাম তাঁর জন্মস্থানের দিকে, যেটি ১৮৪৭ সাল থেকে দেখাশোনা করে আসছেন ”দি শেকসপীয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট”। চেরী, আপেল, নাসপাতি ও নানান ফুল ও ফল গাছের বাগানের মধ্যে ছিমছাম এক দ্বোতলা বাড়ী। ৪৫০ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে সব কিছুই বিশেষ ভাবে আধুনিক করে সাজানো হয়েছে। চার দিকে তাঁর বিভিন্ন কাজের নমুনা প্রদর্শিত হয়েছে। সাজানো রয়েছে শেকসপীয়ার এর সময়কার এবং তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, লেখার কলম, কাগজ, বই পত্র, টেবিল, চেয়ার, ইত্যাদি, তাঁর লেখার ঘরে। তাঁর বাবা ছিলেন এক ছোট ব্যবসাযী। এই বাড়িতেই চামড়ার গ্লাভস তৈরি করে বিক্রি করতেন। উলের ব্যবসাও ছিল। পাশেই একটি ঘরে সেই সব জিনিস, সেই সময়ে যেমন ছিলো সে অবস্থায় সাজানো রয়েছে।  প্রথমেই রয়েছে ফায়ার প্লেস।এরপর একটি শোবার ঘর,খাট বিছানা, বালিশ সব সাজানো ঠিক যেমনটি ছিলো আগে, যেন কেউ এখনি শুতে আসবে। সামনে মোমবাতি জলছে। পাশেই ডাইনিং রুম, চেয়ার টেবিল সব এমনভাবে সবকিছু সেজানো যন কেউ এখনি ব্রেকফাস্টে বসবে। এখানেও টেবিলে মোমবাতি জলছে।পাশের একটি ঘরে চামড়া কেটে গ্লাভস বানানো হত বিক্রির জন্য, তার সব জিনিস যেমন কাঁচি, ছুরি, স্কেল, চামড়া ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা।

এই জন্মস্থান গত ৪৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং বর্তমানে একে আধুনিক করে তোলা হয়েছে, যার চিহ্ন চারদিকেই। বিভিন্ন শতকে এই বাড়ীর রূপ কেমন ছিল, তার সচিত্র বিবরণ পাশের একটি ঘরে পর পর দেওয়া হয়েছে, যাতে দর্শকরা এই ক্রমবির্বতনের একটা ধারনা করতে পারেন।

এরপর আমরা এগিয়ে চললাম মিনিট দশেক হাঁটা পথের দুরত্বে ”হোলি ট্রিনিটি চার্চ” এর দিকে। এই হোলি ট্রিনিটি প্যারিস চার্চ সেই ত্রয়োদশ শতক থেকে এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের জীবনযাপন তথা জীবনধারনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জন্মের পর এই চার্চেই শেকসপীয়ারের ব্যাপটিসম, এর পর বিবাহ এবং শেষে মৃত্যুর পর সমাধি হয়। অসামান্য সুন্দর স্থাপত্যের মাঝে শান্তির মনোরম বাতাবরণই এই চার্চের বিশেষত্ব। ভিতরে মাঝের প্রধান প্রার্থনাকক্ষটির চারপাশের দেওয়ালে সুন্দর কাঠের চোখজুড়ানো কারুকাজ এবং এর ওপরে রঙ্গীন কাঁচের প্যানেলের অসামান্য কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সামনেই রয়েছে তাঁর সমাধি। আর তার সামনে দেওয়া সেই বিষয়ে বিবরণী।

হোলি ট্রিনিটি চার্চ দেখা শেষ করে এর পর আমরা এখান থেকে মাইল দুইতিন দুরে ”অ্যান হ্যাথওয়েস কটেজ” বা বাগানবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এটি শেকসপীয়ারের স্ত্রীর পিতৃনিবাস। সেখানে তাঁদের উত্তরসুরিরা সেসময় থেকে আজ অবধি পুরুষানুক্রমে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী চতুর্দশ পুরুষ ধরে) বসবাস করে আসছেন এবং এখোনো বসবাস করছেন। ৪৫০ বছর পুরোনো অথচ আধুনিক ভাবে সাজানো এই বাড়ী দেখে মুগ্ধ হতে হয়, এবং মনে হয় আমাদের দেশে এমন কবে হবে।

এরপর আমরা দেখতে গেলাম আজকের শেষ গন্তব্য ”মেরী আরডেনস ফার্ম” (শেকসপীয়ারের মা এর বাড়ী)। শেকসপীয়ারের শৈশব কেটেছিল এই বাড়ীতেই। মাত্র সাড়ে তিন মাইল দুরের এই বাডীতে আমরা তাঁর শৈশব কেমন কেটেছিল তার একটা আভাষ পাই, এই বাড়ীতে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা নানান জিনিষপত্রের মাধ্যমে। সেসময় আশেপাশের পরিবেশ যেমন ছিল, বর্তমানের আধুনিকতার মধ্যেও তাকে যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেসময়ের এই টুডোর ফার্মে, ওন্যত্র দেখতে পাওয়া যেত না, এমন নানা রকম সব পাখী যেমন, চিল, ঈগল, পেঁচা ইত্যাদি এখানে পোষা হত এবং তাদের প্রশিক্ষন দেওয়া হত। ঠিক তখনকার মত, এখনো সেইসব পাখীরা রয়েছে এখানে, বিশাল লনের একপাশের শেডের নিচে। তারা তাদের পালকদের প্রশিক্ষণে কেমন পোষ মেনেছে তার পরিচয় আগত দশর্কদের দিচ্ছে। যে কেউ চাইলে এবং কিছু দক্ষিণা দিলে, বিশাল ঈগল কিম্বা পেঁচা আপনার আমার হাতে উড়ে এসে বসবে তার পালকের ইসারায়, দেখে চমকিত হতেই হবে। একটু ভিতরে ভেড়া এবং শুকরের ফার্ম। সব পশুই স্বাস্থবান, নধর ও সজীব প্রাণচঞল। বাদামি শুকরগুলিকে দেখে তাদের গা এত চকচকে লাগলো যে মনে হল এখনি তাদের সাবান ঘসে চান করানো হয়েছে। পিছনেই এক দ্বোতলা বাড়ী, সারা বাড়ীটা সুন্দরভাবে সাজানো কিন্তু থেমে আছে আজ থেকে ৪৫০ বছর আগের সময়ে, তবু ঝকঝকে তকতকে আধুনিক। সেই সময়ের নানান ব্যবহার্য জিনিষপত্রে সাজানো বিভিন্ন ঘর।

দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এলো। আর আজই আমাদের লন্ডন ফিরতে হবে। তাই এরপর ঐতিহ্যশালী শেকসপীয়ারের বাড়ী দেখা শেষ করে লন্ডনের পথে রওনা দিলাম।

ছবি: প্রকাশ চট্টোপাধ্যায় । মাইক

LET’S KEEP IN TOUCH!

We’d love to keep you updated with our latest news and offers 😎

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.