বিবিসি-২ তে হাঙ্গেরির ইহুদিদের নিয়ে একটা প্রোগ্রাম দেখতে-দেখতে আমার বুডাপেস্টের দানিউব নদীর তীরে সদ্য দেখা হৃদয় ছোঁয়া লোহার জুতোর লম্বাসারিগুলোর কথা মনে পড়লো আর তার সাথে মনে পড়লো  আমার ছবিগুলোর কথা । ২৩ বছর পরে আবার বুডাপেস্ট্ এর দানিউব নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে এসে এইবার এক নতুন স্মারক দেখলাম –  নদীর তীরে সারি সারি এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা নানারকমের ও নানান সাইজের জুতো।এই দানিউব নদীর তীরে গাঁথা জুতোগুলো কিন্তু ইতিহাসের এক ভয়াবহ সময় এর ঘটনাটির  শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে গড়েছেন সিনেমা পরিচালক ক্যান টগে আর ভাস্কর গিউলা পাউর ২০০৫ সালে। 

১৯৪০ সালের স্টাইলের লোহার ৬০ জোড়া জুতোগুলো দিয়ে যে স্মারক প্রতিষ্ঠাপিত করা হয়েছে বুডাপেস্ট্ এর দানিউব নদীর তীরে, সেগুলো হুবহু আসল জুতোর মতন দেখতে অথচ লোহার তৈরি । দেখলে মনে হয়না যে এগুলো লোহা দিয়ে সৃষ্ট জুতোর স্মারক ।১৯৪৪ এর অক্টোবর মাসে হিটলার  হাঙ্গেরির সরকারের অধিনায়ক মিক হোর্দিকে সরিয়ে ফেরেন্ক জালাসিকে হাঙ্গেরি সরকারের অধিনায়ক বানালো। তার কারণ জালাসি  হিটলারের এরো ক্রস পার্টির ফ্যাসিস্ট, এন্টি-সেমেটিক/ ইহুদি বিরোধী চিন্তাধারা কে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতো। 

এই পার্টির লোকেরা  নির্মমভাবে প্রকাশ্যে বুডাপেস্টের ইহুদিদের মারধোর ও হত্যা করতো। প্রায় ৮০,০০০ হাঙ্গেরির ইহুদিদের এরা বহিষ্কৃত করে অস্ট্রিয়ার বর্ডারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় আর বাকি ২০,০০০ ইহুদিদের নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে, এই দানিউব নদীর তীরে । এই নিরাপরাধী ইহুদিদের গুলি করে হত্যা করার আগে তাদের জুতো খুলতে বাধ্য করা হতো (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জুতো একটি  দামী ও খুব প্রয়োজনীয় জিনিষ ছিলো, মানুষ জলে ফেলে দেওয়া যায়, তার সাথে জুতো? নৈব নৈব চ!  তাই এই নির্দোষ ইহুদীদের হত্যাকারিরা নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, নির্মমভাবে গুলি করে মেরে ফেলে দিয়েছিলো। যার ফলে তাদের মৃতদেহ  নদীর প্রান্তর থেকে চীৎ হয়ে নদীর হিমায়িত জলে পড়ে মরে ভেসে যায়। উপুড় হয়ে পড়লে যদি কোন রকমে সাঁতার কেটে বেঁচে যায়। কি ভয়াবহ সেই দৃশ্য! কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

এই সাধারণ লম্বাসারিতে বসানো জুতোগুলোর ইতিহাসের সেই জঘন্য পৃষ্ঠটির স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখলে কেমন যেন একটা গা ছমছম করে ওঠে। উঠবেইনা বা কেন? হাজারের সংখ্যায় নিরীহ র্ইহুদিদের কি সাংঘাতিক ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার এগুলো যেন জীবন্ত স্মারক ।জুতোগুলোর স্টাইল দেখতে শুধু একরকমের নয় – কর্মচারীর জুতো, ব্যবসায়ীর জুতো, মহিলাদের হীলতোলা জুতো, এমনকি  কচি বাচ্চাদের জুতো দেখে সেই ভয়াবহ ঘটনাটি বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবে না। কারণ সেই জল্লাদেরা গুলি করে মারার সময়, বয়স, লিঙ্গ,  কাজকর্ম কিছুরই ভেদাভেদ করেনি। তাদের  একমাত্র অপরাধ যে তারা ইহুদি ধর্মাবলম্বী।

নদীর ধারে এই জুতোগুলো  এলোপাতাড়ি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে । দেখে মনে হচ্ছিল সদ্য যেনো ইহুদি মানুষেরা জুতো খুলে রেখেছেন ।  শুধুমাত্র  জুতোর স্মারকটি সেই নিরীহ মানুষগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় যে কি ভয়াবহ ভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে তারা বাধ্য হয়েছিলো।

তবুও বলবো এই দানিউব নদীর তীরের স্মারক জুতোগুলো এক অপূর্ব  সুন্দর শ্রদ্ধা-নিবেদনের আবোহাওয়া সৃষ্টি করেছে । এখানে এসে দাঁড়িয়ে আমার মনে হোল যেন  ইতিহাসের সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি কে চাক্ষুষ দেখতে পারছি ।এই জায়গাটি বুডাপেস্টের, পেস্টের দিকে , ঠিক হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ প্রান্তে। এক অপরূপ সৌন্দর্য মাখা সুর্যাস্তের আলোয়, দানিউব নদীর দুপারে – একদিকে বুডা আর এক দিকে পেস্টের সেতুগুলোতে আলো জ্বলে ওঠে, ঝলমল করে দানিউব নদী আর এক এক করে সমস্ত শহরের আলো জ্বলে উঠছে, তখন সে এক অপরূপ রূপের শহরটিকে দুচোখ ভরে দেখতে-দেখতে ভয়াবহ সময়ের স্মৃতিচিহ্নগুলো কে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে পেরে যেন প্রাণটা  জুড়িয়ে গেলো।

মুখ্য ছবি : HOS70

অন্যান্য ছবিগুলো সুভাষ দের তোলা।

close

LET’S KEEP IN TOUCH!

We’d love to keep you updated with our latest news and offers 😎

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.