শব্দের মধ্যেই অর্থ নিহিত – মহামারী


এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে, ১৪ মাস ধরে সত্যিই কি কেউ আছে যার জানা ছিল না যে আমরা সমস্ত মানবজাতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নই? এবং ভাইরাস কি করে কাজ করে? চরাচরে যখন সবাই ই আক্রান্ত হতে পারে – আমি ভান করে বসে থাকলাম যে আমি শিবঠাকুরের বরদান প্রাপ্ত। তাই করোনার জন্য আমার কোনো দায়-বদ্ধতা নেই। আমি করোনা মুক্ত। এটা কি সত্য-বাণী নয়?

মাথার ওপর বোমা পড়লে তা চোখে দেখা যায়, ভূমিকম্প, সুনামি সবই চোখে দেখে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু, করোনাকে দেখতে না পেলে বিশ্বাস করবো কেন? ডাক্তার, নার্স, নেতা, উপনেতা, টিভি, রেডিও, কাগজ – কে বলেনি, কে ভয় দেখায় নি যে অন্যের নিঃশ্বাসের – প্রশ্বাসের কাছা-কাছি থেকো না, অন্যের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া বাতাসের সন্নিকটে যেয়ো না। দুজনেই – দুজনকে বাঁচাবার চেষ্টা করো।

তার ফল টা কি হলো? হোয়াটস্যাপ, সোশ্যাল-মিডিয়া তে তুমুল হাসির ঝড় উঠলো, মাস্ক নিয়ে হাস্য, কৌতুক, ঠাট্টা কি হলো না? এবং এখনো তাই চলছে। ডিজিটালি শিক্ষিতরা মস্করা বানিয়েই চললো, আর আমরা তা ফরওয়ার্ড করেই চললাম। ফলাফল যখন আমাদের সুবিধে মতো হলো না, তখন আমরা মোদী, বরিস, ট্রাম্প, দিদি – সবাইকে তুলে দে পিটুনি।

সরকার লকডাউন করবে কি করবে না – আমার মাস্ক পরা কি তার ওপর নির্ধারণ করে? লকডাউন করলেও দোষ ,না করলেও দোষ – লকডাউন করলে একদল মারা যাবে, লকডাউন না করলে আরেকদল মারা যাবে।

আমি আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছি, বন্ধ-ঘরের রেস্টুরেন্টে খেয়ে চলেছি, বেড়াতে যাচ্ছি, দূর্গা পুজোয় ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, ভিড় ঠেলে শপিং করছি, বিয়ে-বাড়ি তে সেজে-গুজে এটেন্ড করছি, বন্ধু – বান্ধব – আত্মীয়দের বাড়িতে যত্র – তত্র ঢুকছি – বেরোচ্ছি – মহামারী কিন্তু চলে যায়নি – তাও কিন্তু করছি – স্কুল বন্ধ – কলেজ বন্ধ – তাও না বোঝার ভান করে বসে আছি যেন কোথাও কোনো অসুবিধে নেই।

যখন জানি বিশ্ব জুড়ে সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে হবে, আপামর জনসাধারণ এর কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছলে তবে আমরা এই মহামারী থেকে বেরোতে পারবো – তখনো আমরা ভ্যাকসিনের নামে বদনাম ছড়িয়েছি, ভ্যাকসিন না নিয়ে নষ্ট করেছি, এবং পরিশেষে যখন ভ্যাকসিন কম পড়লো, তখন আবার আট ঘন্টার লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, ওই ভিড় থেকে করোনা নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম।

আমার জীবনের মেয়াদ কবে শেষ হবে – তার অনেকটাই কিন্তু আমার হাতে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, পৃথিবীর কয়েকটি দেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে আবার অনেক কটি দেশই সেভাবে যুদ্ধের কবলে পড়েনি, হয়তো বা দূরত্বের জন্যই বা, কূটনীতির বাইরে থাকার জন্য। করোনা মহামারী কিন্তু এই সম্মিলিত ক্ষয়-ক্ষতির ও অনেক ওপরে।

বিলেত তো ভৌগোলিক আয়তনে ছোট্ট একটি দেশ, লোক-সংখ্যাও খুবই কম। সেই দেশেও যখন এক এক-দিনে এক-হাজার ছশো / এক-হাজার আটশো করে মানুষ মারা যেতে লাগলো, পুরো দেশ লকডাউনের এর কবলে চলে গেলো, ওয়েলফেয়ার সরকার সব ব্যবসা বাণিজ্যকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করে গেলো মাসের পর মাস। কিন্তু, মানুষ নিজেদের চারপাশে নিজেরাই জন্য সেল্ফ-লকডাউন বানিয়ে ফেললো। আমরা এক একটা ছোট দ্বীপের মতো সবাই সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। সব দেশেই কিছু নিয়মভঙ্গকারী থাকে – এরা সবেতেই বিরোধ করে, তারা বাদে সংখ্যাগুরু নাগরিক সম্প্রদায় একজোট হয়ে এই করোনা যুদ্ধে উত্তীর্ণ হলো।

প্রায় ১৪ মাস বাড়ির চৌকাঠ কেউ মাড়ায়নি, ডোমেস্টিক হেল্পারের আসা বন্ধ। বাড়িতে দূর্গা পুজো প্রতিষ্ঠিত হলো, বারোয়ারি বন্ধ হলে বলে। সরকার বাগানে ৬ জন কে আসতে দিয়েছিলো। এক-জন করে মাস্ক পরে মানুষ তার মধ্যেই প্রণাম করে প্রাসাদ নিয়ে বাইরে থেকে দেখে চলে গেলো, ঠাকুমা – দিদিমা রা কাঁচের জানলার ভেতর থেকে, ছোট্ট ছোট্ট নাতি-নাতনিদের কে হাতে-হাত লাগালো, মধ্যিখানে কাঁচের জানলার অন্তরায়, কেয়ার-হোমে নিজের মা, বাবাকে দেখতে যাওয়া বন্ধ,বড়দিনের সময় সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে ছেলেমেয়েদের আসা বন্ধ, স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, সব বন্ধ। লকডাউনের নিয়ম যখন শিথিল করে ফ্যামিলি কে দেখা করতে দিলো, মেয়ে একবার দেখা করতে এলো, তারপর থেকে আবার ৮ মাসের ওপর বাড়ি আসা বন্ধ।

আমার কাজ কখনো বন্ধ হয়নি, এসেনশিয়াল রিসার্চ ক্যাটাগরিতে কিছু রিসার্চ নিয়িমিত চলেছে। নিজের রিস্ক-এসেসমেন্ট করেছি, ট্রিপল-লেয়ারের শিল্ড বানিয়ে কাজ করতে গেছি, পিপিই এর পুরো প্রটেকশন নিয়ে, একটাই উদ্দশ্য আমি যেন ভাইরাস ট্রান্সমিশন হতে না দিই, আমি যেন ভাইরাস নিয়ে বাড়ি না ঢুকি, আমি যেন আমার থেকে অন্যকে ইনফেকশন না দিই। ভাইরাস যায় কোথায়? মানুষের শরীরে। নিজের শরীর কে যতটা পেরেছি সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। খাওয়া – দাওয়া বদল করেছি, প্রাণায়াম শিখেছি, আয়ুর্বেদিক ভেষজ শরীরকে দেবার চেষ্টা করেছি। ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে ফিরেই স্টিম নিয়েছি। সব খাবার অনলাইনে এসেছে, কিন্তু কোনো কারণে দোকানে যেতে হলেই বাড়ি এসে আবার স্টিম নিয়েছি। গাড়ির দরজার হাতল, স্টিয়ারিং সাবান দিয়ে ক্লিন করেছি। প্রতি সপ্তাহে – আরটি-পিসিআর টেস্ট করেছি চলেছি নিয়মিত, যাতে এসিম্পটোমাটিক হয়ে অন্য কাউকে ইনফেকশন না দিই। আমি আমার অংশটুকুই করছি রোজ।

আমার মতো অনেক-কে নিয়েই সমাজ, এবং সমাজকে নিয়েই দেশ। এই মহামারীতে শুধু সরকারের নয়, আমার কিছু কর্তব্য আছে। সর্বোপরি, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বন্ধ করেছি, কারোর ব্যাপারে নেতিবাচক ভাবা, বলা, চিন্তা, সোশ্যাল মিডিয়াতে নেতিবাচক কমেন্ট, মেসেজে ইত্যাদির এর থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করেছি। বাড়ির ভেতর পসিটিভ চিন্তা-ভাবনা, বাড়িকে পরিষ্কার রাখা, সামাজিক কাজ, প্রতিদিন ভার্চুয়াল কমিউনিটি ইভেন্টস চালু রেখেছি। প্রতিটি দিন কমিউনিটি সার্ভিসের ভেতরে নিজেকে সমর্পন করে — করোনার নেগেটিভ চিন্তার বাইরে থাকার সাহায্য পেয়েছি।

প্রকৃতপক্ষে,করোনা জীবনে অনেক নতুন পাঠ পড়ালো, যা আগে জানবার সুযোগ হয়নি। গ্র্যাটিচুডের মানে বুঝেছি। আক্ষরিক মানে নয়, গ্র্যাটিচুড এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ভিতরের অর্থটি বুঝিয়েছে কোভিড মহামারী।

Image Courtesy: Shrobona Bhattacharya

LET’S KEEP IN TOUCH!

We’d love to keep you updated with our latest news and offers 😎

We don’t spam! Read our privacy policy for more info.